09 May 2024, 03:38 am

তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ  শাসন জয় দেখিয়ে নয় ——- এম এ কবীর (সাংবাদিক)

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

প্রতীকি ছবি

বেইলি শব্দের অর্থ প্রাকারবেষ্টিত দুর্গাঙ্গন। বেইলি ব্রিজ- বহুল ব্যবহৃত। দ্রুত সংযোজনযোগ্য সেতু- এভাবে আমরা ব্যবহার করি। ঢাকার মন্ত্রিপাড়া সংলগ্ন ‘ বেইলি রোড’ নামকরণ কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে বেশ বিতর্ক আছে। উইকিপিডিয়ার বর্ণনা মতে- মহীশুরের টিপু সুলতান এর সঙ্গে কর্ণেল বেইলী ও সুনাম অর্জন করেছিলেন। এজন্য তার নামানুসারে বেইলী রোডের নামকরণ করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। অন্য ধারনাটি এইচ বেইলীকে ঘিরে। ওয়াহাবী আন্দোলন দমনকালে স্পেশাল বেঙ্গল পুলিশের ডি, আই, জি, এইচ বেইলী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। তার নামানুসারেই বেইলী রোডের নামকরণ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু ‘প্রাকারবেষ্টিত দুর্গাঙ্গন’- কী নিষ্ঠুর পরিহাস হয়ে উঠল ‘কাচ্চি ভাই’ নামের খাবারের দোকানের জন্য। এখানে একাকারবেষ্টিত ভবনে প্রবেশ করা যায়, তবে বের হবার পথ জানা নেই। ২৯ ফেব্রুয়ারি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষের রাতে বেইলি রোডের একটি ভবন ভয়ঙ্কর মৃত্যুকূপে পরিণত হবে, কে জানত! বেইলি রোডের আগুন নিভে গেছে। ঝরে পড়েছে ৪৬টি মূল্যবান তাজা প্রাণ। আগুনের ছাই উড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে অব্যবস্থাপনার ক্ষত-বিক্ষত চেহারা। দেশের প্রায় সব মানুষই এখন বিক্ষুব্ধ, কিন্তু তাদের ক্ষোভ প্রকাশের কোনো গণতান্ত্রিক পথ খোলা নেই। আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সেই পঙ্‌ক্তি, ‘তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়’।
দুর্নীতি এখন সর্বত্রগামী। ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয় না। পুলিশ আসছে শুনলে লোকে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মারা যায়। কৃষক তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন করে, কিন্তু ন্যায্যমূল্য পায় না। শ্রমিকরা বাঁচার মতো মজুরি চাইলে মালিকের নিয়োজিত মাস্তানরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেই। বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে ভুল চিকিৎসা বা উদাসীনতায় রোগী মারা যাওয়ার হার বেড়েছে। এমনকি খতনার মতো সামান্য অস্ত্রোপচারেও শিশুদের প্রাণ যাচ্ছে। রাস্তায় বের হলে গাড়িচাপা পড়ে মরতে হয় যে কোন সময়।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দুর্নীতিসহ নানা বিষয় নিয়ে সমালোচনা থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক ভালো কারণেও শিরোনাম হয়েছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে দেশ উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়েছে। ঢাকা শহরে অনেক সুউচ্চ অট্টালিকা গড়ে উঠেছে। বড় বড় রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ে একটি আধুনিক শহরের চেহারা আমাদের সামনে তুলে ধরে। কিন্তু এই আপাত আধুনিক শহরে আমরা কতটা নিরাপদ? প্রতিনিয়ত নানা দুর্ঘটনায় মরছে মানুষ । কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা, অগ্নিকান্ডে হতাহতের সংখ্যা। সেই সঙ্গে এসব ক্ষেত্রে বাড়ছে বিচারহীনতা। অনেক অনেক দুর্ঘটনার তদন্তের পেছনে অর্থ ব্যয় নিছকই অপচয়!

ক্ষতি হচ্ছে সম্পদের। যখনই কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটে তখন কিছুদিন হইচই হয়। তদন্ত কমিটি হয়। তদন্তের নামে একে অপরকে দোষারোপ চলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দু-চারজন আসামি গ্রেপ্তার করা হয়। এক সময় তারা ছাড়াও পেয়ে যায়। তার পর সবকিছু আগের মতো স্বাভাবিক। যেন কিছুই ঘটেনি। আরেকটা দুর্ঘটনার আগ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকা। কেউ শোধরায় না। সব দোষ যেন সাধারণ মানুষের। বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছেন তার অভিজ্ঞতার কথা। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনার সময় মন্ত্রী ছিলেন শ ম রেজাউল করিম। ওই অগ্নিকান্ডে ২৬ জন নিহত হন। ঘটনা তদন্তে তখন উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। তদন্তের পর দোষীদের চিহ্নিত করে রিপোর্ট দেয় কমিটি। কিন্তু আজও বিচার হয়নি। ফেসবুক পোস্টে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী লিখেছেন, ‘বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ডের বিচার আজও হয়নি। এফ আর টাওয়ারের আগুন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল ভবনগুলোর অব্যবস্থাপনা ও দেখভাল করার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সংস্থার ব্যর্থতা। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি করেছিলাম একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে। ৬২ জনকে দায়ী করা হয়েছিল ভবন নির্মাণ ও তদারকির সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো দায়ীদের সব তথ্য দিয়েছিলাম দুর্নীতি দমন কমিশনকে। অপ্রিয় হলেও সত্য, যাদের দায় নিরূপণ করা হয়েছিল তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। যাদের দায় নিরূপণ করেছিল উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি তাদের চেয়ে নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই দায়ীদের একটি অংশকে অব্যাহতি দিয়ে দিলেন। তাদের জামিন হয়ে গেল। কোনো কোনো আসামিকে একদিনের জন্যও জেলে যেতে হয়নি।’ সাবেক মন্ত্রীর এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে এটা প্রতীয়মান হয় যে, এ দেশে এসব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অতটা সহজ নয়। যেখানে মন্ত্রীর মতো ব্যক্তিও অক্ষমতা প্রকাশ করেন, সেখানে সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার আশা দুরাশা মাত্র।
কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে বা আগুনে পুড়ে মানুষ মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলো এক সুরে কথা বলতে থাকে। সবার তখন এক কথা, এ অনুমতি ছিল না, সে সনদ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেও তাই। মানুষ মরলেই বলা শুরু হয়ে যায়, চালকের লাইসেন্স ছিল না, গাড়ির ফিটনেস ছিল না, নির্ধারিত গতির চেয়ে বেশি জোরে চলছিল।
বেইলি রোডের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। রাজউক বলছে, ভবনটিতে রেস্টুরেন্ট করার অনুমতি ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না। তিনবার নোটিশ দেয়ার পরও ব্যবস্থা নেয়নি ভবন মালিক বা রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। সিঁড়িতে রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। দুর্ঘটনার পর এসব অনিয়ম এখন সামনে আনা হচ্ছে। আনছেন কারা? যাদের এসব অনিয়ম দেখার কথা ছিল তারা। তা হলে তারা এতদিন কোথায় ছিলেন। যদি এসব অনিয়মের কথা তারা জানতেনই তবে ব্যবস্থা কেন নেননি? বেইলি রোডের আগুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার ক্ষেত্রে এটার ব্যতিক্রম হয়নি। ভবন মালিক ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও যাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে এতগুলো মানুষের মৃত্যু হলো মামলায় তাদের কাউকেই আসামি করা হয়নি। বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত যে কয়েক কোটি। তারা চাল-ডাল-চিনি-ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে, কিন্তু অভিজাত এলাকার খাবারের মান ও দাম নিয়ে নিশ্চুপ। ভবনগুলো যে মৃত্যুকূপ, সে ভাবনাও খাবারের জন্য অপেক্ষার সময় মনে থাকে না।
রোম যখন পোড়ে, নিরো তখন বাঁশি বাজায়!’ ‘নিরো’ হচ্ছে তারা যাদের কিছুতেই কিছু যায় আসে না, ভ্রুক্ষেপহীন; অথবা যে নিজেই অনাচার সৃষ্টি করে, গায়ে বাতাস লাগিয়ে ঘুরেছিল সেই নগর রাষ্ট্রের রোমে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম কেন হয়েছিল? হবস, রুশো, কান্টের মতো দার্শনিকরা একমত যে, রাষ্ট্রের জন্ম হয় মূলত এর নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য অথবা এদের জন্য সর্বোচ্চ ভালো’র ব্যবস্থা করার জন্য। বাংলাদেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক অবস্থা নিরূপণ করলে, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার চরিত্র সংজ্ঞায়িত করা কঠিন কিছু নয়। এখানে গরিব আর মধ্যবিত্তদের জন্য মৃত্যুর আয়োজন যেন সবখানে। শুধু পালাবদলের অপেক্ষা মাত্র।
বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে যে ৪৬ জন মানুষ নির্মমভাবে আগুনে পুড়ে মারা গেছেন, তা রাষ্ট্রের কাছে একটা পরিসংখ্যান মাত্র, কিন্তু তাদের স্বজনদের কাছে এ এক অবর্ণনীয় বেদনা, যা মাপা যায় না, অথবা পৃথিবীর কোনও কিছু দিয়ে যার ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব না। অথচ এই মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ প্রতিরোধে আইনের কোনও অভাব ছিল না।
২০০৮ সালের ২৯ মে, ‘ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮’ প্রণীত হয়। যা ১৯৫১ সালে ‘পূর্ববঙ্গ ইমারত নির্মাণ অধ্যাদেশ’ ছিল। এই অধ্যাদেশের পরে ১৯৫২ সালে ‘ইমারত নির্মাণ আইন’ হয়, যা ১৯৫৩ সাল থেকে কার্যকর হয়। ১৯৫৩ সালে মূলত গৃহায়ন ও গণপূর্ত অধিদফতর কর্তৃক প্রণীত টাউন ইমপ্রুভমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে একটি পূর্ণাঙ্গ বিধিমালা, যা বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের (বিএনবিসি) নিয়ম অনুসরণ করে তৈরি করা। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে নতুন বিল্ডিং কোড প্রণয়ন করা হয়। ইমারত নির্মাণ আইনের ৩ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, ইমারত নির্মাণ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনও উদ্দেশ্যে ইমারত ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ আবাসিক বাড়ির জন্য ইমারত নির্মাণের অনুমতি নিলে ওই ভবনকে অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা যাবে না। বর্তমানে বড় শহরের আবাসিক ভবনের বিভিন্ন তলায় দোকান, রেস্টুরেন্ট, গুদাম বা ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়ে অফিস করার প্রবণতা দেখা যায়। এমনটা আইনের ব্যত্যয়, কারণ আইনের এমন লঙ্ঘন ইমারত নির্মাণ বিধিমালার পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিল সংক্রান্ত বিধিতেও মামলাযোগ্য অপরাধ। ইমারত আইনের ১৫ ধারায় স্পষ্টভাবে আলো-বাতাসের চলাচলের ব্যবস্থার কথা বলা আছে। এই আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে, জরুরি নির্গমনের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ের যেকোনও ফ্লোরের সর্বোচ্চ ২৫ মিটার থাকতে হবে। এই নির্গমন পথ সিঁড়ি আকারে হতে হবে এবং নিচতলার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে। ধারায় আরও বলা আছে, অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রকাশ্য স্থানে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র বা বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রত্যেক ফ্লোরে ফায়ার অ্যালার্মের কথাও বলা আছে।  একই কোডের ৪ ও ৫ ধারায় এমন ফায়ার অ্যালার্ম রাখার কথা বলা আছে, যা আগুন, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্ত করতে সক্ষম। অন্যদিকে, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩-এর ৮ ধারা অনুযায়ী বহুতল বা বাণিজ্যিক ভবনে আগুন নির্বাপণের জন্য গৃহীত ব্যবস্থা বিল্ডিং নির্মাণের ১৮০ দিনের মধ্যেই ফায়ার ব্রিগেডের মহাপরিচালকের কাছে উপস্থাপন করতে হবে। এই আইনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভবন পরিদর্শন করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। পরিদর্শন শেষে যদি তার কাছে প্রতীয়মান হয় যে উক্ত ভবনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে নেয়া হয়নি, তাহলে ভবনটি ব্যবহারের উপযোগী নয় বলে ঘোষণা দেয়া যাবে। এই মর্মে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ও সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি হাইকোর্ট ডিভিশনে একটা রিট পিটিশন (৭১৮/২০০৮) দায়ের করে, যেখানে ভবনের মৌলিক বা ন্যূনতম নিরাপত্তা নিশ্চিতের আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো সব ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করার দাবি জানানো হয়। হাইকোর্ট এই বিষয়ে গাইডলাইনও দেয়। তারপরও নিমতলি, তাজরিন ফ্যাশন, চকবাজার, গুলশান ডিসিসি মার্কেট এবং সর্বশেষ বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ট্র্যাজেডিগুলো বন্ধ হয় না।
কোন ভবন, বিল্ডিং কোড অনুযায়ী কোন শ্রেণিভুক্ত হবে, তা আগে থেকেই নিশ্চিত করতে হবে, এবং পরবর্তীতে কোনোভাবেই শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। অথচ সবার নাকের ডগায় একটা আবাসিক এলাকায়, আবাসিক ভবন তৈরি করে, পরে তা সম্পূর্ণ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা হয়। এভাবেই আইনের পাশ কাটিয়ে কত কিছু চলছে ‘ম্যানেজ’ করে। হয়তো আরও কোন ভয়াবহ দুর্যোগ অপেক্ষা করছে নিকট ভবিষ্যতে। তখন আগেরটা ভুলে, আমরা নতুনটা নিয়ে মাতম করবো।
এ কেমন সমাজ? রাজপথে নিরাপত্তা নেই। ঈদের কাপড় কিনতে গেলে দগ্ধ হতে হয়। সপ্তাহ শেষে সপরিবারে পানাহারের জন্য রেস্তোরাঁতে খাবার খেতে গেলে কখনও কখনও আগুনের কালো ধোঁয়া শ্বাস চেপে ধরে। মেধাবী তরুনতরুণীর সম্ভাবনার মৃতু ঘটে; আর মধ্যবিত্ত সপরিবারে প্রাণ হারায়। দেশের রাজধানীতে পোশাকি উন্নয়নের শেষ নেই। চকচকে দালান, বাহারি রেস্তোরাঁ, সুসজ্জিত মনিহারি দোকান আর ঝকঝকে মেট্রোরেলের আধুনিকতা উন্নয়নের নামে প্রতারণা করে শুধু! দুর্ঘটনা ঘটে গেলে টিভি চ্যানেলগুলো স্বজনের আহাজারিকে তুলে ধরে দিনরাত। আমরা দর্শক হয়ে কখনও হাহাকারে সুর মেলাই; কখনও ক্ষোভ প্রকাশ করে স্বর উঁচু করি। এ পর্যন্তই। দায়িত্ব কেউই নিতে চায়না। সরকার দোষ দেয় ভবন মালিককে; ভবন মালিক দেন স্থপতিকে; স্থপতি দেন ব্যবসায়ীকে। সুশীল সমাজ হতাশাগ্রস্ত হয়ে হাল ছাড়ে; নৈরাশ্যের বাণী শোনায়। আর প্রকৌশলী-স্থপতিরা ভবন পরিত্যাগের প্রেসক্রিপশন দেয়। এটিই কি তবে সাধারণ মধ্যবিত্তের ললাট লিখন?
২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর পোশাকশিল্পে নিরাপত্তা বেড়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি পোশাকশিল্পে যখন আঘাত এসেছে, তখন টনক নড়েছে আমাদের। গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘বাংলাদেশ অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি’ ও ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। বাংলাদেশের ১৫১টি ব্র্যান্ড বা কোম্পানি এর স্বাক্ষরকারী। এই অ্যাকর্ড বা অ্যালায়েন্স প্রতিষ্ঠানগুলো বৈদেশিক ব্র্যান্ডের অর্থায়নে নিয়মিত গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যবেক্ষক দল পাঠিয়েছে এবং গার্মেন্টস কারখানার ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে।
২০২১ সালে প্রকাশিত একটি সন্দর্ভে ভিয়েতনামের হ্যানয় শহরের বহুতল ভবনের ব্যবস্থাপনায় ‘কন্ট্রোল অল্টারনেটিভ’ কৌশল অবলম্বনের উল্লেখ রয়েছে। অর্থাৎ যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ব্যবস্থার বাইরেও বাজারভিত্তিক (মার্কেট কন্ট্রোল) ও গোষ্ঠীভিত্তিক (ক্ল্যান কন্ট্রোল) প্রণোদনাকে কাজে লাগানো যায়। মার্কেট কন্ট্রোল পন্থা যে কাজ করে তা রানা প্লাজা-পরবর্তী পদক্ষেপগুলোই প্রমাণ দিয়েছে। তবে হ্যানয় শহরে ভবনে অগ্নিকান্ড হ্রাসে ক্ল্যান কন্ট্রোল কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। প্রশাসনিক নিয়মের পাশাপাশি সামাজিক দায়িত্ববোধ ভিয়েতনামে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। যদি সাধারণ মানুষ ভবনে আগুনের ঝুঁকি সম্পর্কে অবগত হয় এবং দুর্ঘটনার সময় ভবন ত্যাগের কৌশল ফায়ার ড্রিলের মাধ্যমে আয়ত্তে আনতে পারে, তবে এই ক্ল্যান কন্ট্রোল বাংলাদেশেও অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।
বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ ভিক্টর ফ্রাঙ্কেলকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্য বন্দিদের সঙ্গে এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে নেয়া হচ্ছিল। আউশউইৎজ ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে তিনি বাতাসে লাশের গন্ধ পান। কারণ নাৎসিরা সেখানে শিশুদের পর্যন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। ভিক্টর ফ্রাঙ্কেল এই অসহায়ত্বের ভেতরেও জীবনের মানে খুঁজেছেন। যুদ্ধ শেষে তৈরি করেছেন মনস্তত্ত্বের বিখ্যাত শাখা ‘লোগোথেরাপি’। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের যখন নিজের নামটি পর্যন্ত পরিত্যাগ করতে হয়েছিল, তখনও সেখানে আশা ছিল। সেই ক্যাম্পেও প্রেম ছিল; বেজেছিল ভায়োলিনের সুর, পিতা আশায় বুক বেঁধেছিলেন সন্তানকে আরেকবার আলিঙ্গন করার জন্য। বেইলি রোডের বাতাসে লাশের গন্ধ রয়েছে ঠিকই,তবে সেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েই আমরা আশাবাদী হতে চাই।

লেখক : এম এ কবীর, ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

  • Visits Today: 2727
  • Total Visits: 708557
  • Total Visitors: 2
  • Total Countries: 1125

আজকের বাংলা তারিখ

  • আজ বৃহস্পতিবার, ৯ই মে, ২০২৪ ইং
  • ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ (গ্রীষ্মকাল)
  • ১লা জ্বিলকদ, ১৪৪৫ হিজরী
  • এখন সময়, রাত ৩:৩৮

Archives

MonTueWedThuFriSatSun
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031  
       
  12345
2728     
       
     12
3456789
10111213141516
17181920212223
31      
  12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
27282930   
       

https://youtu.be/dhqhRb9y018